আল্লাহর প্রেমে আসক্তি হয়ে কে কি করেছেন জানুন

প্রেম - আসক্তি কি জানুন




                     প্রেম-আসক্তি

    প্রেম-আসক্তি আল্লাহর প্রেমে আসক্তি হয়ে কে কি করেছেন জানুন                কোন সুন্দর ও প্রিয়দর্শন বস্তুর প্রতি অন্তরে আগ্রহ আকর্ষণ সৃষ্টি হওয়াকে ভালবাসা বলা হয়। এ আগ্রহ আকর্ষণই অন্তরে বদ্ধমূল হয়ে তীব্রতর রূপ করলে তার নাম প্রেম-আসক্তি বা 'ইশক' হয়। প্রেমাসক্তির সর্বশেষ পর্যাে প্রেমিক প্রেমাস্পদের জন্য ধন-দৌলত, মান-সম্মান সর্বস্ব অকাতরে বিসর্জন দেয়। প্রেমিকা যোলায়খা হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের প্রেমে এত হয়েছিলেন যে, তিনি স্বীয় রূপ-গুণ, ধন-সম্পদ সবকিছু বিসর্জন দিয়েছিলেন। সত্তরটি উটের বোঝার সমান সোনা-রূপার অলংকার ছিল; এসব কিছুই তিনি হযরত ইউসুফের জন্য উৎসর্গ করে দেন। তিনি হযরত ইউসুফের প্রেমে এমন মত্ত হয়েছিলেন যে, কেউ তার নিকট এসে যদি শুধু এতটুকু বলত, আমি তোমার ইউসুফকে দেখেছি, তৎক্ষণাৎ তিনি তাকে একটি অমূল্য স্বর্ণের হার উপহার দিয়ে সারা জীবনের জন্য সম্পদশালী করে দিতেন। এভাবে দান করতে করতে এক সময় তিনি নিজে একেবারে নিঃস্ব দরিদ্রে পরিণত হয়েছিলেন।     যেদিকে তাকাতেন সেদিকেই কেবল ইউসুফ আর ইউসুফই দেখতে পেতেন; এমনকি আসমানের তারকারাজিতেও তিনি ইউসুফের নাম লেখা দেখতেন। চোখে সবকিছুই ইউসুফের ন্যায় দেখতেন ।    হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর প্রেমে বিদগ্ধ যোলায়খা যখন ইসলাম গ্রহণ করেন      তখন ঈমানী নূর লাভে ধন্য হন, অনন্তর হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর সাথে প্রণয়সূত্রে আবদ্ধ হওয়ায় তিনি তাঁর থেকে আলাদা হয়ে নীরব একাকিত্বে এমনভাবে আল্লাহ্র ইবাদতে মশগুল হয়ে যান যে, কেবলমাত্র আল্লাহ্র ইবাদতের জন্য তিনি সব ধরনের জাগতিক সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকেন। হযরত ইউসুফ (আঃ) দিনের বেলা তাঁকে আহ্বান করলে তিনি রাতের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে আহ্বান থেকে মুক্ত হতেন। আবার রাতে আহ্বান করলে দিনের কথা বলে নিষ্কৃতি চাইতেন ।    একদা খোলায়খা হযরত ইউসুফ (আঃ)-কে লক্ষ্য করে বললেন : 'হে ইউসুফ! আল্লাহ্র পরিচয় লাভের পূর্বে আমি তোমাকে মহব্বত করতাম; এখন আমি আল্লাহর পরিচয় লাভ করেছি; ফলে একমাত্র তাঁর মহব্বত ছাড়া আমার হৃদয় থেকে সব ধরনের গায়রুল্লাহর মহব্বত দূর হয়ে গেছে। এ জন্য আমি কোন বিনিময়েরও প্রত্যাশী নই।' হযরত ইউসুফ (আঃ) বললেন, 'হে খোলায়খা! আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা আমাকে বলেছেন, তোমার গর্ভে দু'টি পুত্র সন্তান জন্ম নিবে এবং তাদের আল্লাহ্ তা'আলা নবুওয়ত দান করবেন। হযরত ষোলায়খা বললেন, যেহেতু আল্লাহ্ তা'আলা আপনাকে বলেছেন এবং এজন্য আমাকে উপায় ও উসিলা হিসাবে নির্ধারণ করেছেন, তাই তাঁর এ নির্দেশ আমার জন্য শিরোধার্য।”    একদা লায়লার প্রেমিক মজনুকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, 'তোমার নাম কি?' তখন সে বলেছিল, 'আমার নাম লায়লা।' বস্তুত লায়লার প্রেমে আত্মলীন। হওয়ার কারণেই স্বীয় অস্তিত্ব বিস্তৃত হয়ে যাওয়ায় এমনটা হয়েছে। একদা এক লোক মজনুকে বলেছিল, কি হে মজনু! লায়লা কি মরে গেছে? জবাবে সে বলেছিল : 'নিঃসন্দেহে লায়লা জীবিত, সে আমার অন্তরে বিরাজমান; আমিই লায়লা। একদা মজনু লায়লার বাড়ী অতিক্রমকালে আসমানের দিকে তাকাচ্ছিল। তখন এক ব্যক্তি তাকে লক্ষ্য করে বলেছিল, 'হে মজনু! আকাশ পানে কি দেখছ? আকাশ-পানে না তাকিয়ে লায়লার গৃহ প্রাচীরের দিকে দেখতে থাক; এভাবে হয়ত তাকে এক নজর দেখে নিতে পারবে।' তখন মজনু বলেছিল। : আমি দেখছি আকাশের তারকারাজি, এগুলো আমার কাছে অতি প্রিয়; কেননা এগুলোর ছায়া লায়লার বাড়ীর উপর পড়ে।'    হযরত মনসুর হাল্লাজ (রঃ) সম্পর্কে বর্ণিত আছে,      লোকেরা আঠার দিন পর্যন্ত তাঁকে বন্দী করে রেখেছিল। এ সময় হযরত শিবলী (রঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'হে মনসুর! মহব্বতের হাকীকত কি?' জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আজ নয়, আগামীকাল বলব।' পরের দিন লোকেরা তাঁকে বন্দিশালা থেকে বের করে হত্যার উদ্দেশে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাচ্ছিল। তখন হযরত শিবলী (রঃ)ও সে পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন হযরত মনসুর হাল্লাজ (রঃ) তাঁকে দেখে চিৎকার করে বললেন, 'হে শিবলী! শুনে নিন, মহব্বতের হাকীকত হচ্ছে, সূচনাতে অগ্নিদগ্ধ হওয়া আর পরিণামে জীবন উৎসর্গ করা।    হযরত মনসুর হাল্লাজ (রঃ) যখন এ বাস্তব সত্য উপলব্ধি করলেন, একমাত্র আল্লাহ্র সত্তাই চিরঞ্জীব, শাশ্বত; আর সবকিছুই ভঙ্গুর ও ধ্বংসপ্রাপ্ত, তখন তাঁর অন্তরে বদ্ধমূল হয়ে গেল, পার্থিব সবকিছুতে একমাত্র আল্লাহর সত্তা, কুদরত ও মহিমা বিরাজিত । তখন তিনি স্বীয় নামটুকুও বিস্তৃত হয়ে গেলেন। তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করা হল, আপনি কে? তখন তিনি বলতেন, 'আনাল হক'—আমি হক।    এক বুযুর্গ বলেছেন, 'খাঁটি মহব্বতের লক্ষণ তিনটি। এক. স্বয়ং মাহবুর তথা প্রেমাস্পদের যবানে কথা বলা। দুই. সমগ্র মাখলুকের সংসর্গ ত্যাগ করে কেবল মাহবুবের সান্নিধ্য অবলম্বন করা। তিন. অন্য সবকিছুর সন্তুষ্টি ও তোষামোদ পরিত্যাগ করে কেবল মাহবুবের সন্তুষ্টির জন্য ব্যাকুল থাকা।    প্রেমের নিগূঢ়তত্ত্ব হচ্ছে, গোপনীয়তার পর্দা ছিন্ন করে দেয়া, আচ্ছাদিত সকল রহস্য উন্মোচন করা, প্রেমাস্পদের ধ্যানমগ্নতা ও স্মৃতিচারণের অমৃত আশ্বাসে উন্মত্ততায় আত্মহারা হওয়া, যেন দেহের কোন অঙ্গ ছিন্ন করলেও বিন্দুমাত্র অনুভূত না হয়।    ফোরাত নদীর তীরে এক লোক গোসল করছিল। এ সময় সে অপর এক লোকের কণ্ঠে নিম্নের আয়াতের তেলাওয়াত শুনেছিল : ‎‫وامتازوا اليوم أيها المجرمون .‬‎    —হে পাপীরা! আজ তোমরা আলাদা হয়ে যাও।' –সূরা ইয়াসীন ঃ ৫৯ আয়াতটি শোনার সাথে সাথে এর হৃদয়বিদারক প্রতিক্রিয়ার প্রভাবে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে তৎক্ষণাৎ সে নদীতে ডুবে মৃত্যুবরণ করে।    মুহাম্মদ আবদুল্লাহ বাগদাদী (রঃ) বলেছেন,    আমি বসরা শহরে উঁচু একটি অট্টালিকার ছাদের উপর থেকে এক যুবককে দেখেছি। সে উঁকি দিয়ে পথচারীদের লক্ষ্য করে বলছে— প্রেমের তরে প্রাণ উৎসর্গ না করে কেউ কখনও কল্যাণ লাভে সক্ষম হয়নি। অতএব যদি কোন নিবেদিতপ্রাণ বক্তি তার প্রেমাস্পদের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতে চায়, তবে সে যেন এভাবে মৃত্যুবরণ করে। একথা বলে সে তৎক্ষণাৎ ছাদের উপর থেকে মাটিতে পড়ে গেল। পরক্ষণেই লোকজন তাকে উঠিয়ে দেখে, সে মারা গেছে।’    হযরত জুনায়দ বাগদাদী (রঃ) বলেন, 'আসল তাসাওউফ হচ্ছে সব ধরনের খবর ও অবস্থা থেকে বেখবর উদাসীন থাকার নাম ।    একদিন হযরত যুন্নুন মিসরী (রঃ) মসজিদে হারামের একটি স্তম্ভের নীচে এক যুবককে নেহায়েত পীড়িত ও বিবস্ত্র অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। তার বক্ষ থেকে আহ্ আহ্ শব্দ বের হচ্ছে। হযরত যুনুন বলেন, 'এ অবস্থা দেখে আমি তাকে সালাম দিয়ে পরিচয় জানতে চাইলাম।' সে বলল, 'আমি একজন প্রেমিক মুসাফির; রোগে আক্রান্ত হয়ে পথে পড়ে আছি।' তার জবাবে আমি বিষয়টি বুঝতে পেরে বললাম, 'আমি তোমার মতই একজন।' একথা শুনে সে ক্রন্দন করতে লাগল, আমিও তার সাথে কাঁদলাম। অতঃপর সে জিজ্ঞেস করল, তুমি কাঁদছ কেন?' জবাবে আমি বললাম, ‘তোমার মত আমিও একজন আশেক মুসাফির।' একথা শুনে সে আরও অধিক পরিমাণে ক্রন্দন করতে লাগল এবং এ অবস্থাতেই হঠাৎ সজোরে এক চিৎকার দিয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হল। অনন্তর আমি কাপড় দিয়ে তার দেহ ঢেকে দিয়ে কাফন ক্রয়ের জন্য বাজারে গেলাম । বাজার থেকে কাফন নিয়ে প্রত্যাবর্তন করে দেখি, সে নেই। তখন আমি আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললাম, সুবহানাল্লাহ (কোথায় গেল), এমন সময় অদৃশ্য থেকে আওয়াজ ভেসে এলো, “হে যুনুন! সে এমন এক পথিক, যাকে শয়তান আক্রমণ করতে চেয়েছে, কিন্তু পারেনি, তোমার সম্পদের কিয়দংশ তাকে স্পর্শ করতে চেয়েছে, তা-ও হয়নি, রেদওয়ান ফেরেশতা তাকে জান্নাতে আহ্বান জানিয়েছে: ভাও সে প্রত্যাখ্যান করেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এখন সে কোথায় আছে?'    উত্তর এলো :  ‎‫في مقعد صدق عند مليان مقني .‬‎    -যোগা আসনে, সর্বাধিপতি সম্রাটের সান্নিধ্যে।' –সূরা কামার : ৫৪ যুবকটিকে উক্ত পুরস্কারে ভূষিত করার কারণ হচ্ছে, সে ছিল আল্লাহর আশেক, অত্যধিক ইবাদতে নিমগ্ন থাকত এবং দ্রুতপায়ে তওবা অনুশোচনায় আগামী হত।    জনৈক বুযুর্গের নিকট প্রেমানুরাগ ও মহব্বতের তাৎপর্য সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন : জীবের সাথে সম্পর্ক কমিয়ে দিয়ে অধিকতর নির্জনতা ও একাকিত্ব অবলম্বন করবে, সর্বদা চিন্তাশীল থাকবে, নিশ্চুপ থাকবে, চোখের দৃষ্টি নির্লিপ্ত রাখবে, পার্থিব আহ্বানে সাড়া দেবে না, কিছু বলা হলে অনুধাবন করবে না, বিপদে ধৈর্যহারা হবে না, ক্ষুধা তৃষ্ণায় অস্থির হবে না, কেউ গালি দিলে, ভর্ৎসনা করলে সেদিকে কর্ণপাত করবে না, মানুষকে ভয় করবে না, নির্জনে আল্লাহ্ তা'আলার ধ্যানে মগ্ন থাকবে, সর্বদা তাঁর প্রতি আকৃষ্ট থাকবে একা একা নীরবে মোনাজাত করবে, পার্থিব ঝঞ্ঝাটে দুনিয়াদারদের থেকে দূরে থাকবে।'    হযরত আবু তোরাব বখশী (রঃ) ভালবাসা সম্পর্কে কয়েক পংক্তি কবিতা আবৃত্তি করেন।      সেগুলোর মর্ম হল : 'পার্থিব কোন বিষয়ে ধোকায় পড়ো না; প্রতারিত হয়ো না। কেননা, এসবই প্রেমিকের জন্য প্রেমাস্পদের উপঢৌকন। যে দুঃখ-কষ্ট ও বালা-মসিবত প্রেমাস্পদের তরফ থেকে আসে, প্রেমিক সে সবই সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ করে । অভাব-অনটন এবং দারিদ্র্যকেও প্রেমাস্পদের তরফ থেকে নগদ দান, সম্মান ও সন্তুষ্টির নিদর্শন বলে মনে করে। প্রকৃত প্রেমিকের আরেক লক্ষণ হচ্ছে, শত্রুর শত তিরস্কার, ধিক্কার এবং প্রতারণা সত্ত্বেও সে অবিচল থাকে; তার পদস্খলন হয় না; বরং উত্তরোত্তর প্রেমিকের প্রতি তার প্রত্যয় ও আসক্তি বাড়তে থাকে।'    হযরত ঈসা (আঃ) একদা এক যুবকের পাশ দিয়ে পথ অতিক্রম করছিলেন।    যুবকটি বাগানে পানি সিঞ্চন করছিল। হযরত ঈসা (আঃ)-কে দেখে যুবক বলল, 'হে আল্লাহর নবী! আপনি আমার জন্য দোয়া করুন, যেন আল্লাহ্ তা'আলা আমাকে তাঁর ভালবাসার অণু পরিমাণ অংশ দান করেন। হযরত ঈসা (আঃ) বললেন, 'তুমি তা সইতে পারবে না।' যুবক বলল, 'তাহলে অর্ধাণু পরিমাণের জন্য দোয়া করুন। হযরত ঈসা (আঃ) দোয়া করলেন, 'হে মহান প্রভু! এ যুবককে আপনার মহব্বতের অর্থাৎ পরিমাণ দান করুন। দোয়ার পর হযরত ঈসা (আঃ) আপন পথে চলে গেলেন।    বহুকাল পর তিনি সেই যুবকের বাড়ীর পাশ দিয়ে অতিক্রমকালে ভার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। লোকজন বলল, বহুদিন যাবত যুবকটি পাগল অবস্থায় ছিল এবং বর্তমানে পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় ঘুরে বেড়ায়। এ সংবাদ পেয়ে হযরত ঈসা (আঃ) দোয়া করলেন, 'হে আল্লাহ্! সেই নওজোয়ানের সাথে আমাকে দেখা করিয়ে দিন। দোয়ার পর হযরত ঈসা (আঃ) দেখলেন, সে যুবক পর্বতমালার মাঝখানে একটি উঁচু শৃঙ্গে আকাশপানে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হযরত ঈসা (আঃ) তাকে সালাম দিলেন, কিন্তু সে কোন উত্তর দিল না। পুনরায় হযরত ঈসা (আঃ) নিজের পরিচয় প্রদান করে বললেন, 'আমি ঈসা।' এ সময় আল্লাহর তরফ থেকে হযরত ঈসা (আঃ)-এর প্রতি ওহী নাযিল হল ঃ হে ঈসা! যার হৃদয়ে আমার ভালবাসা অর্ধাণু পরিমাণও প্রবেশ করেছে, সে কখনও মানুষের আওয়াজ শুনতে পায় না। শুনে রাখ, আমার মহত্ত্ব ও পরাক্রমশীলতার কসম, তুমি এখন তাকে করাত দিয়ে চৌচির করে দিলেও সে বিন্দুমাত্র আনুভব করবে না ।    যে লোক স্বীয় জীবনে তিনটি বিষয়ের দাবী করেছে;    অথচ আত্মাকে অপর তিনটি বিষয়ের কলুষতা থেকে মুক্ত করতে পারেনি, সে নির্ঘাত ধোঁকায় পড়ে রয়েছে। এক. হৃদয়ে আল্লাহ্র যিকিরের সুমিষ্ট স্বাদ আস্বাদের দাবী করে, অথচ পার্থিব বিষয়ের মহব্বত থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেনি। দুই. ইবাদতে এখলাস নিষ্ঠার দাবী করে; অথচ মানুষের নিকট সম্মান সুযশের লিপ্সা পরিত্যাগ করেনি। তিন. আল্লাহ্ প্রেমের দাবী করে; অথচ নিজেকে তুচ্ছ নিকৃষ্টতম ভাবে না। রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছেন—    ‎‫يحبون‬‎ ‎‫سيأتي زمان على امتى يحبون خمسا وينسون.‬‎ ‎‫الدنيا وينسون الأخـرة و يـجنـون الـمـال ويـنسـون الـحـسـاب و يحبون‬‎ ‎‫التوبة ويحبون‬‎ ‎‫الخلق وينسون الخالق ويحبون الذنوب وينسون التوبة و‬‎    ‎‫القصور و ينسون المقبرة.‬‎    আসবে, যখন তারা পাচটি বিষয়কে ভালবাসবে, কিন্তু তৎসঙ্গে অপর পাঁচটি ——সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন আমার উম্মতের উপর এমন এক সময় ভুলে যাবে। তারা ইহকালকে ভালবাসবে, কিন্তু পরকাল ভুলে যাবে। তারা বিষয় ধন-সম্পদ ভালবাসবে, কিন্তু এর হিসাব প্রদানের কথা ভুলে যাবে।     তারা পাপকর্মকে ভালবাসবে, কিন্তু তওবার কথা ভুলে যাবে। তারা বড় বড় ইমারত ভালবাসবে, কিন্তু কবরের কথা ভুলে যাবে।    মনসুর ইবনে আম্মার (রঃ) এক যুবককে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছিলেন      'হে যুবক! তুমি সদা-সর্বদা সাবধান থাক; যৌবন যেন তোমাকে প্রতারিত না করে। বহু যুবককে দেখা গেছে, জীবনে কৃত অপরাধসমূহ থেকে তওবা করতে দেরি করেছে, অন্তরে দীর্ঘ আশা পোষণ করেছে, মৃত্যুর কথা স্মরণ করেনি কেবল বলেছে, আগামীকাল অথবা পরশু তওবা করব। এভাবে দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর আর তওবার সুযোগ হয়নি, বঞ্চিত প্রতারিত হয়েই সে ইহকাল ত্যাগ করেছে। যখন কবরে পৌঁছেছে তখন সে একেবারে রিক্ত। পার্থিব প্রচুর ধন-দৌলত, দাস-দাসী, বাবা-মা, পরিবার-পরিজন, সন্তান-সন্ততি কিছুই তার কোন কাজে আসেনি। যেমন কালামে পাকে আল্লাহ্ তা'আলা এরশাদ করেছেন—    ‎‫لا ينفع مال ولا بنون ـ إلا من أتى الله بقلب سليم .‬‎    — 'আখেরাতে কোন অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কারও কোন কাজে আসবে না। সে ব্যক্তিই মুক্তি পাবে, যে সুস্থ মন নিয়ে আল্লাহ্র কাছে পৌঁছবে।    —সূরা শুআরা : ৮৮-৮৯    হে আল্লাহ্! আমাদের মৃত্যুর পূর্বে তওবা করার তওফীক দিন, উদাসীনতা থেকে নাজাত দিন, হাশরের মাঠে আপনার হাবীব (ছঃ)-এর শাফাআত নসীব করুন। মূলতঃ আসল ঈমানের পরিচয় হল, সুযোগের প্রথম অবস্থাতেই তার সদ্ব্যবহার করা, অর্থাৎ তওবা করা, কৃত পাপকর্মের উপর অনুতপ্ত হওয়া, লজ্জা অনুতাপে ভেঙ্গে পড়া, নশ্বর দুনিয়ার ন্যূনতম রিযিক ও দ্রব্যের উপর তুষ্ট থাকা, পার্থিব যাবতীয় বিষয় থেকে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত থাকা এবং ইখলাস নিষ্ঠার সাথে আল্লাহ্র ইবাদতে ডুবে থাকা ।    একদা জনৈক বখিল মোনাফেক স্বীয় স্ত্রীকে কসম দিয়ে বলেছিল,    'তুমি কোন মিসকীনকে দান-খয়রাত করলে আমি তোমাকে তালাক প্রদান করব।' পরবর্তী কোন এক সময়ে একজন মিসকীন এসে এ বখিল মোনাফেকের দ্বারে এসে হাঁক ছেড়ে বলল, 'হে গৃহবাসী! আমাকে আল্লাহ্র ওয়াস্তে কিছু দান কর । ঘর থেকে স্ত্রী তাকে তিনটি রুটি দান করে।' রুটি নিয়ে পথ অতিক্রমকালে অকস্মাৎ সেই মিসকীন মোনাফেকের সামনে পড়লে সে জিজ্ঞেস করল, 'তুমি এ রুটি কোথায় পেলে?' মিসকীন লোকটি মোনাফেকের গৃহের কথা বলল । বাড়িতে পৌঁছে সে স্ত্রীকে শাসনের স্বরে জিজ্ঞেস করল, 'আমি কি তোমাকে কসম দিয়ে বলিনি, দান-খয়রাত করলে তোমাকে তালাক দেব?' বলল, আমি আল্লাহর নামে দান করেছি। একথা শুনে মোনাফেক ক্ষেপে গিয়ে একটি আগুনের কুণ্ডলা প্রজ্বলিত করে তাকে আল্লাহর নামে উত্তপ্ত আগুনে ঝাঁপ দিতে আদেশ করে। স্ত্রী গহনা-অলঙ্কারে সজ্জিতা হয়ে প্রস্তুত হয়ে গেল। এ সময় মোনাফেক স্বামী তাকে অলঙ্কার খুলে ফেলার নির্দেশ দিলে স্ত্রী জবাবে বলল, বন্ধু বন্ধুর জন্য উত্তম সাজে সজ্জিত হয়ে থাকে; এখন আমি আমার প্রিয় বন্ধুর সাক্ষাতলাভে ধন্য হতে যাচ্ছি' — একথা বলেই সে আগুনের কুণ্ডলীতে ঝাঁপিয়ে গাড়। মোনাফেক আগুনের কুণ্ডলী ঢেকে রেখে চলে গেল। তিন দিন পর ফিরে এসে কুণ্ডলীর উপরের ঢাকনা তুলে দেখল, তার স্ত্রী দিব্যি আগের মতই সহী-সালামতে জীবিত রয়েছে। এ দৃশ্য অবলোকনে সে বিশ্বয়াভিভূত হয়ে গেল। এমন সময় অদৃশ্য থেকে একটি শব্দ ভেসে এলো, 'তোমার কি এ কথার উপর ঈমান নেই যে, আগুন কখনও আমার প্রিয়জনকে স্পর্শ করে না।'    ফেরাউনের স্ত্রী হযরত আছিয়া স্বীয় ঈমানের বিষয়টি বহু দিন পর্যন্ত গোপন রেখেছিলেন। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি ফেরাউনের গোচরীভূত হলে সে হযরত আছিয়াকে নানাভাবে শাস্তি প্রদানের নির্দেশ দিল। ফেরাউনের নির্দেশে তাকে বহু রকমে উৎপীড়ন করা হল। ফেরাউন আছিয়াকে তাঁর দ্বীন ত্যাগ করতে বললে তিনি ফেরাউনের সে আহবান প্রত্যাখ্যান করে স্বীয় দ্বীনের উপর অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে স্থিত থাকেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে পেরেক পুঁতে দেয়া হয়েছিল। এ অবস্থায়ও ফেরআউন যখন তাঁকে দ্বীন ঈমান ত্যাগ করাতে পারল না, তখন তিনি উত্তর করেন : 'হে ফেরআউন! তুমি আমার দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উপর ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পার, কিন্তু হৃদয় তো আল্লাহ্র হাতে; সেখানে তোমার কোন ক্ষমতা অধিকার করা চলবে না। জেনে রাখ, তুমি আমার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে টুকরো টুকরো করে ফেললেও তাতে আমার ঈমানে কোন প্রকার দুর্বলতা প্রকাশ পাওয়া তো দূরের কথা; বরং এতে আমার ঈমান আরও বৃদ্ধি পাবে।'    এ সময় হযরত মূসা (আঃ) হযরত আছিয়ার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন হযরত আছিয়া তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, আল্লাহ্ তাঁর উপর সন্তুষ্ট আছেন কিনা? হযরত মূসা (আঃ) বললেন, 'হে আছিয়া! আকাশের ফেরেশতাকুল তোমার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে এবং আল্লাহ্ তা'আলা তাদের সম্মুখে তোমার বিষয়ে গৌরব করছেন, তোমার সকল মনস্কামনা এখন তুমি আল্লাহ্র নিকট চেয়ে নাও, তিনি তোমার দোয়া মঞ্জুর করবেন।' তখন হযরত আছিয়া কোরআনের ভাষায় দোয়া করলেন -      ‎‫وعـمـلـه‬‎ ‎‫رب ابن لـى عـنـدك بيتا في الجنة ونجن‬‎    ‎‫ونجني من القوم الظلمين .‬‎    ——হে আমার রব! আপনার সন্নিকটে জান্নাতে আমার জন্য একটি গৃহ নির্মাণ করুন, আমাকে ফেরাউন ও তার দুষ্কর্ম থেকে উদ্ধার করুন এবং আমাকে জালেম কওম থেকে মুক্তি দিন।' –সূরা তাহ্রীম : ১১    হযরত সালমান (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ফেরাউন যখন তার স্ত্রী আছিয়াকে প্রখর রৌদ্রে শাস্তি প্রদান করত, তখন ফেরেশতারা স্ব স্ব ডানা দ্বারা তাঁকে ছায়া প্রদান করত। হযরত আছিয়া তখন জান্নাতে তাঁর আবাসস্থল অবলোকন করতেন।    হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ফেরাউন তার স্ত্রী আছিয়ার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে চারটি পেরেক পুঁতে বুকের উপর ভারী পেষণ-যন্ত্র স্থাপন করে রেখেছিল। এহেন অবস্থায় তার চেহারা প্রখর রৌদ্রে উত্তপ্ত সূর্যের দিকে ফিরিয়ে রাখত । এ সময় হযরত আছিয়া আকাশপানে মাথা তুলে দোয়া করতেন, ‘ওগো আল্লাহ্! তোমার অতি নিকটে জান্নাতের মাঝে আমাকে আবাস দান কর।'    হযরত হাসান (রঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, 'আল্লাহ্ তা'আলা হযরত আছিয়াকে অতি উত্তমরূপে মুক্তি দিয়ে এবং জান্নাতে তাঁকে অতি উচ্চ মর্যাদা প্রদান করেছেন। তিনি জান্নাতের সকল স্থানে বিচরণ করেন এবং পানাহার করে থাকেন।' সুতরাং ইবাদতকারীর কর্তব্য হচ্ছে, সদাসর্বদা আল্লাহ্র নিকট গুনাহ মাফ চাওয়া; কেবল তাঁরই নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করা। কেননা, বিপদ আপদে উৎপীড়ন থেকে মুক্তির জন্য প্রার্থনা করা পূতঃ-পবিত্র নেক বান্দাদের তরীকা এবং এটাই প্রকৃত ঈমানের লক্ষণ।'    লেখাটির মঝ্য ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।









    কোন সুন্দর ও প্রিয়দর্শন বস্তুর প্রতি অন্তরে আগ্রহ আকর্ষণ সৃষ্টি হওয়াকে ভালবাসা বলা হয়। এ আগ্রহ আকর্ষণই অন্তরে বদ্ধমূল হয়ে তীব্রতর রূপ করলে তার নাম প্রেম-আসক্তি বা 'ইশক' হয়। প্রেমাসক্তির সর্বশেষ পর্যাে প্রেমিক প্রেমাস্পদের জন্য ধন-দৌলত, মান-সম্মান সর্বস্ব অকাতরে বিসর্জন দেয়। প্রেমিকা যোলায়খা হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের প্রেমে এত হয়েছিলেন যে, তিনি স্বীয় রূপ-গুণ, ধন-সম্পদ সবকিছু বিসর্জন দিয়েছিলেন। সত্তরটি উটের বোঝার সমান সোনা-রূপার অলংকার ছিল; এসব কিছুই তিনি হযরত ইউসুফের জন্য উৎসর্গ করে দেন। তিনি হযরত ইউসুফের প্রেমে এমন মত্ত হয়েছিলেন যে, কেউ তার নিকট এসে যদি শুধু এতটুকু বলত, আমি তোমার ইউসুফকে দেখেছি, তৎক্ষণাৎ তিনি তাকে একটি অমূল্য স্বর্ণের হার উপহার দিয়ে সারা জীবনের জন্য সম্পদশালী করে দিতেন। এভাবে দান করতে করতে এক সময় তিনি নিজে একেবারে নিঃস্ব দরিদ্রে পরিণত হয়েছিলেন। 


    যেদিকে তাকাতেন সেদিকেই কেবল ইউসুফ আর ইউসুফই দেখতে পেতেন; এমনকি আসমানের তারকারাজিতেও তিনি ইউসুফের নাম লেখা দেখতেন। চোখে সবকিছুই ইউসুফের ন্যায় দেখতেন ।


    হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর প্রেমে বিদগ্ধ যোলায়খা যখন ইসলাম গ্রহণ করেন 



    তখন ঈমানী নূর লাভে ধন্য হন, অনন্তর হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর সাথে প্রণয়সূত্রে আবদ্ধ হওয়ায় তিনি তাঁর থেকে আলাদা হয়ে নীরব একাকিত্বে এমনভাবে আল্লাহ্র ইবাদতে মশগুল হয়ে যান যে, কেবলমাত্র আল্লাহ্র ইবাদতের জন্য তিনি সব ধরনের জাগতিক সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকেন। হযরত ইউসুফ (আঃ) দিনের বেলা তাঁকে আহ্বান করলে তিনি রাতের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে আহ্বান থেকে মুক্ত হতেন। আবার রাতে আহ্বান করলে দিনের কথা বলে নিষ্কৃতি চাইতেন ।


    একদা খোলায়খা হযরত ইউসুফ (আঃ)-কে লক্ষ্য করে বললেন : 'হে ইউসুফ! আল্লাহ্র পরিচয় লাভের পূর্বে আমি তোমাকে মহব্বত করতাম; এখন আমি আল্লাহর পরিচয় লাভ করেছি; ফলে একমাত্র তাঁর মহব্বত ছাড়া আমার হৃদয় থেকে সব ধরনের গায়রুল্লাহর মহব্বত দূর হয়ে গেছে। এ জন্য আমি কোন বিনিময়েরও প্রত্যাশী নই।' হযরত ইউসুফ (আঃ) বললেন, 'হে খোলায়খা! আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা আমাকে বলেছেন, তোমার গর্ভে দু'টি পুত্র সন্তান জন্ম নিবে এবং তাদের আল্লাহ্ তা'আলা নবুওয়ত দান করবেন। হযরত ষোলায়খা বললেন, যেহেতু আল্লাহ্ তা'আলা আপনাকে বলেছেন এবং এজন্য আমাকে উপায় ও উসিলা হিসাবে নির্ধারণ করেছেন, তাই তাঁর এ নির্দেশ আমার জন্য শিরোধার্য।”


    একদা লায়লার প্রেমিক মজনুকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, 'তোমার নাম কি?' তখন সে বলেছিল, 'আমার নাম লায়লা।' বস্তুত লায়লার প্রেমে আত্মলীন। হওয়ার কারণেই স্বীয় অস্তিত্ব বিস্তৃত হয়ে যাওয়ায় এমনটা হয়েছে। একদা এক লোক মজনুকে বলেছিল, কি হে মজনু! লায়লা কি মরে গেছে? জবাবে সে বলেছিল : 'নিঃসন্দেহে লায়লা জীবিত, সে আমার অন্তরে বিরাজমান; আমিই লায়লা। একদা মজনু লায়লার বাড়ী অতিক্রমকালে আসমানের দিকে তাকাচ্ছিল। তখন এক ব্যক্তি তাকে লক্ষ্য করে বলেছিল, 'হে মজনু! আকাশ পানে কি দেখছ? আকাশ-পানে না তাকিয়ে লায়লার গৃহ প্রাচীরের দিকে দেখতে থাক; এভাবে হয়ত তাকে এক নজর দেখে নিতে পারবে।' তখন মজনু বলেছিল। : আমি দেখছি আকাশের তারকারাজি, এগুলো আমার কাছে অতি প্রিয়; কেননা এগুলোর ছায়া লায়লার বাড়ীর উপর পড়ে।'


    হযরত মনসুর হাল্লাজ (রঃ) সম্পর্কে বর্ণিত আছে,



     লোকেরা আঠার দিন পর্যন্ত তাঁকে বন্দী করে রেখেছিল। এ সময় হযরত শিবলী (রঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'হে মনসুর! মহব্বতের হাকীকত কি?' জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আজ নয়, আগামীকাল বলব।' পরের দিন লোকেরা তাঁকে বন্দিশালা থেকে বের করে হত্যার উদ্দেশে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাচ্ছিল। তখন হযরত শিবলী (রঃ)ও সে পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন হযরত মনসুর হাল্লাজ (রঃ) তাঁকে দেখে চিৎকার করে বললেন, 'হে শিবলী! শুনে নিন, মহব্বতের হাকীকত হচ্ছে, সূচনাতে অগ্নিদগ্ধ হওয়া আর পরিণামে জীবন উৎসর্গ করা।


    হযরত মনসুর হাল্লাজ (রঃ) যখন এ বাস্তব সত্য উপলব্ধি করলেন, একমাত্র আল্লাহ্র সত্তাই চিরঞ্জীব, শাশ্বত; আর সবকিছুই ভঙ্গুর ও ধ্বংসপ্রাপ্ত, তখন তাঁর অন্তরে বদ্ধমূল হয়ে গেল, পার্থিব সবকিছুতে একমাত্র আল্লাহর সত্তা, কুদরত ও মহিমা বিরাজিত । তখন তিনি স্বীয় নামটুকুও বিস্তৃত হয়ে গেলেন। তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করা হল, আপনি কে? তখন তিনি বলতেন, 'আনাল হক'—আমি হক।


    এক বুযুর্গ বলেছেন, 'খাঁটি মহব্বতের লক্ষণ তিনটি। এক. স্বয়ং মাহবুর তথা প্রেমাস্পদের যবানে কথা বলা। দুই. সমগ্র মাখলুকের সংসর্গ ত্যাগ করে কেবল মাহবুবের সান্নিধ্য অবলম্বন করা। তিন. অন্য সবকিছুর সন্তুষ্টি ও তোষামোদ পরিত্যাগ করে কেবল মাহবুবের সন্তুষ্টির জন্য ব্যাকুল থাকা।


    প্রেমের নিগূঢ়তত্ত্ব হচ্ছে, গোপনীয়তার পর্দা ছিন্ন করে দেয়া, আচ্ছাদিত সকল রহস্য উন্মোচন করা, প্রেমাস্পদের ধ্যানমগ্নতা ও স্মৃতিচারণের অমৃত আশ্বাসে উন্মত্ততায় আত্মহারা হওয়া, যেন দেহের কোন অঙ্গ ছিন্ন করলেও বিন্দুমাত্র অনুভূত না হয়।


    ফোরাত নদীর তীরে এক লোক গোসল করছিল। এ সময় সে অপর এক লোকের কণ্ঠে নিম্নের আয়াতের তেলাওয়াত শুনেছিল : ‎‫وامتازوا اليوم أيها المجرمون .‬‎


    —হে পাপীরা! আজ তোমরা আলাদা হয়ে যাও।' –সূরা ইয়াসীন ঃ ৫৯ আয়াতটি শোনার সাথে সাথে এর হৃদয়বিদারক প্রতিক্রিয়ার প্রভাবে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে তৎক্ষণাৎ সে নদীতে ডুবে মৃত্যুবরণ করে।


    মুহাম্মদ আবদুল্লাহ বাগদাদী (রঃ) বলেছেন, 


    আমি বসরা শহরে উঁচু একটি অট্টালিকার ছাদের উপর থেকে এক যুবককে দেখেছি। সে উঁকি দিয়ে পথচারীদের লক্ষ্য করে বলছে— প্রেমের তরে প্রাণ উৎসর্গ না করে কেউ কখনও কল্যাণ লাভে সক্ষম হয়নি। অতএব যদি কোন নিবেদিতপ্রাণ বক্তি তার প্রেমাস্পদের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতে চায়, তবে সে যেন এভাবে মৃত্যুবরণ করে। একথা বলে সে তৎক্ষণাৎ ছাদের উপর থেকে মাটিতে পড়ে গেল। পরক্ষণেই লোকজন তাকে উঠিয়ে দেখে, সে মারা গেছে।’


    হযরত জুনায়দ বাগদাদী (রঃ) বলেন, 'আসল তাসাওউফ হচ্ছে সব ধরনের খবর ও অবস্থা থেকে বেখবর উদাসীন থাকার নাম ।


    একদিন হযরত যুন্নুন মিসরী (রঃ) মসজিদে হারামের একটি স্তম্ভের নীচে এক যুবককে নেহায়েত পীড়িত ও বিবস্ত্র অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। তার বক্ষ থেকে আহ্ আহ্ শব্দ বের হচ্ছে। হযরত যুনুন বলেন, 'এ অবস্থা দেখে আমি তাকে সালাম দিয়ে পরিচয় জানতে চাইলাম।' সে বলল, 'আমি একজন প্রেমিক মুসাফির; রোগে আক্রান্ত হয়ে পথে পড়ে আছি।' তার জবাবে আমি বিষয়টি বুঝতে পেরে বললাম, 'আমি তোমার মতই একজন।' একথা শুনে সে ক্রন্দন করতে লাগল, আমিও তার সাথে কাঁদলাম। অতঃপর সে জিজ্ঞেস করল, তুমি কাঁদছ কেন?' জবাবে আমি বললাম, ‘তোমার মত আমিও একজন আশেক মুসাফির।' একথা শুনে সে আরও অধিক পরিমাণে ক্রন্দন করতে লাগল এবং এ অবস্থাতেই হঠাৎ সজোরে এক চিৎকার দিয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হল। অনন্তর আমি কাপড় দিয়ে তার দেহ ঢেকে দিয়ে কাফন ক্রয়ের জন্য বাজারে গেলাম । বাজার থেকে কাফন নিয়ে প্রত্যাবর্তন করে দেখি, সে নেই। তখন আমি আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললাম, সুবহানাল্লাহ (কোথায় গেল), এমন সময় অদৃশ্য থেকে আওয়াজ ভেসে এলো, “হে যুনুন! সে এমন এক পথিক, যাকে শয়তান আক্রমণ করতে চেয়েছে, কিন্তু পারেনি, তোমার সম্পদের কিয়দংশ তাকে স্পর্শ করতে চেয়েছে, তা-ও হয়নি, রেদওয়ান ফেরেশতা তাকে জান্নাতে আহ্বান জানিয়েছে: ভাও সে প্রত্যাখ্যান করেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এখন সে কোথায় আছে?'


    উত্তর এলো :

    ‎‫في مقعد صدق عند مليان مقني .‬‎


    -যোগা আসনে, সর্বাধিপতি সম্রাটের সান্নিধ্যে।' –সূরা কামার : ৫৪ যুবকটিকে উক্ত পুরস্কারে ভূষিত করার কারণ হচ্ছে, সে ছিল আল্লাহর আশেক, অত্যধিক ইবাদতে নিমগ্ন থাকত এবং দ্রুতপায়ে তওবা অনুশোচনায় আগামী হত।


    জনৈক বুযুর্গের নিকট প্রেমানুরাগ ও মহব্বতের তাৎপর্য সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন : জীবের সাথে সম্পর্ক কমিয়ে দিয়ে অধিকতর নির্জনতা ও একাকিত্ব অবলম্বন করবে, সর্বদা চিন্তাশীল থাকবে, নিশ্চুপ থাকবে, চোখের দৃষ্টি নির্লিপ্ত রাখবে, পার্থিব আহ্বানে সাড়া দেবে না, কিছু বলা হলে অনুধাবন করবে না, বিপদে ধৈর্যহারা হবে না, ক্ষুধা তৃষ্ণায় অস্থির হবে না, কেউ গালি দিলে, ভর্ৎসনা করলে সেদিকে কর্ণপাত করবে না, মানুষকে ভয় করবে না, নির্জনে আল্লাহ্ তা'আলার ধ্যানে মগ্ন থাকবে, সর্বদা তাঁর প্রতি আকৃষ্ট থাকবে একা একা নীরবে মোনাজাত করবে, পার্থিব ঝঞ্ঝাটে দুনিয়াদারদের থেকে দূরে থাকবে।'


    হযরত আবু তোরাব বখশী (রঃ) ভালবাসা সম্পর্কে কয়েক পংক্তি কবিতা আবৃত্তি করেন। 



    সেগুলোর মর্ম হল : 'পার্থিব কোন বিষয়ে ধোকায় পড়ো না; প্রতারিত হয়ো না। কেননা, এসবই প্রেমিকের জন্য প্রেমাস্পদের উপঢৌকন। যে দুঃখ-কষ্ট ও বালা-মসিবত প্রেমাস্পদের তরফ থেকে আসে, প্রেমিক সে সবই সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ করে । অভাব-অনটন এবং দারিদ্র্যকেও প্রেমাস্পদের তরফ থেকে নগদ দান, সম্মান ও সন্তুষ্টির নিদর্শন বলে মনে করে। প্রকৃত প্রেমিকের আরেক লক্ষণ হচ্ছে, শত্রুর শত তিরস্কার, ধিক্কার এবং প্রতারণা সত্ত্বেও সে অবিচল থাকে; তার পদস্খলন হয় না; বরং উত্তরোত্তর প্রেমিকের প্রতি তার প্রত্যয় ও আসক্তি বাড়তে থাকে।'


    হযরত ঈসা (আঃ) একদা এক যুবকের পাশ দিয়ে পথ অতিক্রম করছিলেন। 


    যুবকটি বাগানে পানি সিঞ্চন করছিল। হযরত ঈসা (আঃ)-কে দেখে যুবক বলল, 'হে আল্লাহর নবী! আপনি আমার জন্য দোয়া করুন, যেন আল্লাহ্ তা'আলা আমাকে তাঁর ভালবাসার অণু পরিমাণ অংশ দান করেন। হযরত ঈসা (আঃ) বললেন, 'তুমি তা সইতে পারবে না।' যুবক বলল, 'তাহলে অর্ধাণু পরিমাণের জন্য দোয়া করুন। হযরত ঈসা (আঃ) দোয়া করলেন, 'হে মহান প্রভু! এ যুবককে আপনার মহব্বতের অর্থাৎ পরিমাণ দান করুন। দোয়ার পর হযরত ঈসা (আঃ) আপন পথে চলে গেলেন।


    বহুকাল পর তিনি সেই যুবকের বাড়ীর পাশ দিয়ে অতিক্রমকালে ভার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। লোকজন বলল, বহুদিন যাবত যুবকটি পাগল অবস্থায় ছিল এবং বর্তমানে পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় ঘুরে বেড়ায়। এ সংবাদ পেয়ে হযরত ঈসা (আঃ) দোয়া করলেন, 'হে আল্লাহ্! সেই নওজোয়ানের সাথে আমাকে দেখা করিয়ে দিন। দোয়ার পর হযরত ঈসা (আঃ) দেখলেন, সে যুবক পর্বতমালার মাঝখানে একটি উঁচু শৃঙ্গে আকাশপানে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হযরত ঈসা (আঃ) তাকে সালাম দিলেন, কিন্তু সে কোন উত্তর দিল না। পুনরায় হযরত ঈসা (আঃ) নিজের পরিচয় প্রদান করে বললেন, 'আমি ঈসা।' এ সময় আল্লাহর তরফ থেকে হযরত ঈসা (আঃ)-এর প্রতি ওহী নাযিল হল ঃ হে ঈসা! যার হৃদয়ে আমার ভালবাসা অর্ধাণু পরিমাণও প্রবেশ করেছে, সে কখনও মানুষের আওয়াজ শুনতে পায় না। শুনে রাখ, আমার মহত্ত্ব ও পরাক্রমশীলতার কসম, তুমি এখন তাকে করাত দিয়ে চৌচির করে দিলেও সে বিন্দুমাত্র আনুভব করবে না ।


    যে লোক স্বীয় জীবনে তিনটি বিষয়ের দাবী করেছে;


     অথচ আত্মাকে অপর তিনটি বিষয়ের কলুষতা থেকে মুক্ত করতে পারেনি, সে নির্ঘাত ধোঁকায় পড়ে রয়েছে। এক. হৃদয়ে আল্লাহ্র যিকিরের সুমিষ্ট স্বাদ আস্বাদের দাবী করে, অথচ পার্থিব বিষয়ের মহব্বত থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেনি। দুই. ইবাদতে এখলাস নিষ্ঠার দাবী করে; অথচ মানুষের নিকট সম্মান সুযশের লিপ্সা পরিত্যাগ করেনি। তিন. আল্লাহ্ প্রেমের দাবী করে; অথচ নিজেকে তুচ্ছ নিকৃষ্টতম ভাবে না। রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছেন—


    ‎‫يحبون‬‎ ‎‫سيأتي زمان على امتى يحبون خمسا وينسون.‬‎ ‎‫الدنيا وينسون الأخـرة و يـجنـون الـمـال ويـنسـون الـحـسـاب و يحبون‬‎ ‎‫التوبة ويحبون‬‎ ‎‫الخلق وينسون الخالق ويحبون الذنوب وينسون التوبة و‬‎


    ‎‫القصور و ينسون المقبرة.‬‎


    আসবে, যখন তারা পাচটি বিষয়কে ভালবাসবে, কিন্তু তৎসঙ্গে অপর পাঁচটি ——সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন আমার উম্মতের উপর এমন এক সময় ভুলে যাবে। তারা ইহকালকে ভালবাসবে, কিন্তু পরকাল ভুলে যাবে। তারা বিষয় ধন-সম্পদ ভালবাসবে, কিন্তু এর হিসাব প্রদানের কথা ভুলে যাবে।


     তারা পাপকর্মকে ভালবাসবে, কিন্তু তওবার কথা ভুলে যাবে। তারা বড় বড় ইমারত ভালবাসবে, কিন্তু কবরের কথা ভুলে যাবে।


    মনসুর ইবনে আম্মার (রঃ) এক যুবককে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছিলেন 



    'হে যুবক! তুমি সদা-সর্বদা সাবধান থাক; যৌবন যেন তোমাকে প্রতারিত না করে। বহু যুবককে দেখা গেছে, জীবনে কৃত অপরাধসমূহ থেকে তওবা করতে দেরি করেছে, অন্তরে দীর্ঘ আশা পোষণ করেছে, মৃত্যুর কথা স্মরণ করেনি কেবল বলেছে, আগামীকাল অথবা পরশু তওবা করব। এভাবে দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর আর তওবার সুযোগ হয়নি, বঞ্চিত প্রতারিত হয়েই সে ইহকাল ত্যাগ করেছে। যখন কবরে পৌঁছেছে তখন সে একেবারে রিক্ত। পার্থিব প্রচুর ধন-দৌলত, দাস-দাসী, বাবা-মা, পরিবার-পরিজন, সন্তান-সন্ততি কিছুই তার কোন কাজে আসেনি। যেমন কালামে পাকে আল্লাহ্ তা'আলা এরশাদ করেছেন—


    ‎‫لا ينفع مال ولا بنون ـ إلا من أتى الله بقلب سليم .‬‎


    — 'আখেরাতে কোন অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কারও কোন কাজে আসবে না। সে ব্যক্তিই মুক্তি পাবে, যে সুস্থ মন নিয়ে আল্লাহ্র কাছে পৌঁছবে।


    —সূরা শুআরা : ৮৮-৮৯


    হে আল্লাহ্! আমাদের মৃত্যুর পূর্বে তওবা করার তওফীক দিন, উদাসীনতা থেকে নাজাত দিন, হাশরের মাঠে আপনার হাবীব (ছঃ)-এর শাফাআত নসীব করুন। মূলতঃ আসল ঈমানের পরিচয় হল, সুযোগের প্রথম অবস্থাতেই তার সদ্ব্যবহার করা, অর্থাৎ তওবা করা, কৃত পাপকর্মের উপর অনুতপ্ত হওয়া, লজ্জা অনুতাপে ভেঙ্গে পড়া, নশ্বর দুনিয়ার ন্যূনতম রিযিক ও দ্রব্যের উপর তুষ্ট থাকা, পার্থিব যাবতীয় বিষয় থেকে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত থাকা এবং ইখলাস নিষ্ঠার সাথে আল্লাহ্র ইবাদতে ডুবে থাকা ।


    একদা জনৈক বখিল মোনাফেক স্বীয় স্ত্রীকে কসম দিয়ে বলেছিল,


     'তুমি কোন মিসকীনকে দান-খয়রাত করলে আমি তোমাকে তালাক প্রদান করব।' পরবর্তী কোন এক সময়ে একজন মিসকীন এসে এ বখিল মোনাফেকের দ্বারে এসে হাঁক ছেড়ে বলল, 'হে গৃহবাসী! আমাকে আল্লাহ্র ওয়াস্তে কিছু দান কর । ঘর থেকে স্ত্রী তাকে তিনটি রুটি দান করে।' রুটি নিয়ে পথ অতিক্রমকালে অকস্মাৎ সেই মিসকীন মোনাফেকের সামনে পড়লে সে জিজ্ঞেস করল, 'তুমি এ রুটি কোথায় পেলে?' মিসকীন লোকটি মোনাফেকের গৃহের কথা বলল । বাড়িতে পৌঁছে সে স্ত্রীকে শাসনের স্বরে জিজ্ঞেস করল, 'আমি কি তোমাকে কসম দিয়ে বলিনি, দান-খয়রাত করলে তোমাকে তালাক দেব?' বলল, আমি আল্লাহর নামে দান করেছি। একথা শুনে মোনাফেক ক্ষেপে গিয়ে একটি আগুনের কুণ্ডলা প্রজ্বলিত করে তাকে আল্লাহর নামে উত্তপ্ত আগুনে ঝাঁপ দিতে আদেশ করে। স্ত্রী গহনা-অলঙ্কারে সজ্জিতা হয়ে প্রস্তুত হয়ে গেল। এ সময় মোনাফেক স্বামী তাকে অলঙ্কার খুলে ফেলার নির্দেশ দিলে স্ত্রী জবাবে বলল, বন্ধু বন্ধুর জন্য উত্তম সাজে সজ্জিত হয়ে থাকে; এখন আমি আমার প্রিয় বন্ধুর সাক্ষাতলাভে ধন্য হতে যাচ্ছি' — একথা বলেই সে আগুনের কুণ্ডলীতে ঝাঁপিয়ে গাড়। মোনাফেক আগুনের কুণ্ডলী ঢেকে রেখে চলে গেল। তিন দিন পর ফিরে এসে কুণ্ডলীর উপরের ঢাকনা তুলে দেখল, তার স্ত্রী দিব্যি আগের মতই সহী-সালামতে জীবিত রয়েছে। এ দৃশ্য অবলোকনে সে বিশ্বয়াভিভূত হয়ে গেল। এমন সময় অদৃশ্য থেকে একটি শব্দ ভেসে এলো, 'তোমার কি এ কথার উপর ঈমান নেই যে, আগুন কখনও আমার প্রিয়জনকে স্পর্শ করে না।'


    ফেরাউনের স্ত্রী হযরত আছিয়া স্বীয় ঈমানের বিষয়টি বহু দিন পর্যন্ত গোপন রেখেছিলেন। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি ফেরাউনের গোচরীভূত হলে সে হযরত আছিয়াকে নানাভাবে শাস্তি প্রদানের নির্দেশ দিল। ফেরাউনের নির্দেশে তাকে বহু রকমে উৎপীড়ন করা হল। ফেরাউন আছিয়াকে তাঁর দ্বীন ত্যাগ করতে বললে তিনি ফেরাউনের সে আহবান প্রত্যাখ্যান করে স্বীয় দ্বীনের উপর অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে স্থিত থাকেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে পেরেক পুঁতে দেয়া হয়েছিল। এ অবস্থায়ও ফেরআউন যখন তাঁকে দ্বীন ঈমান ত্যাগ করাতে পারল না, তখন তিনি উত্তর করেন : 'হে ফেরআউন! তুমি আমার দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উপর ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পার, কিন্তু হৃদয় তো আল্লাহ্র হাতে; সেখানে তোমার কোন ক্ষমতা অধিকার করা চলবে না। জেনে রাখ, তুমি আমার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে টুকরো টুকরো করে ফেললেও তাতে আমার ঈমানে কোন প্রকার দুর্বলতা প্রকাশ পাওয়া তো দূরের কথা; বরং এতে আমার ঈমান আরও বৃদ্ধি পাবে।'


    এ সময় হযরত মূসা (আঃ) হযরত আছিয়ার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন হযরত আছিয়া তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, আল্লাহ্ তাঁর উপর সন্তুষ্ট আছেন কিনা? হযরত মূসা (আঃ) বললেন, 'হে আছিয়া! আকাশের ফেরেশতাকুল তোমার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে এবং আল্লাহ্ তা'আলা তাদের সম্মুখে তোমার বিষয়ে গৌরব করছেন, তোমার সকল মনস্কামনা এখন তুমি আল্লাহ্র নিকট চেয়ে নাও, তিনি তোমার দোয়া মঞ্জুর করবেন।' তখন হযরত আছিয়া কোরআনের ভাষায় দোয়া করলেন -



    ‎‫وعـمـلـه‬‎ ‎‫رب ابن لـى عـنـدك بيتا في الجنة ونجن‬‎


    ‎‫ونجني من القوم الظلمين .‬‎


    ——হে আমার রব! আপনার সন্নিকটে জান্নাতে আমার জন্য একটি গৃহ নির্মাণ করুন, আমাকে ফেরাউন ও তার দুষ্কর্ম থেকে উদ্ধার করুন এবং আমাকে জালেম কওম থেকে মুক্তি দিন।' –সূরা তাহ্রীম : ১১


    হযরত সালমান (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ফেরাউন যখন তার স্ত্রী আছিয়াকে প্রখর রৌদ্রে শাস্তি প্রদান করত, তখন ফেরেশতারা স্ব স্ব ডানা দ্বারা তাঁকে ছায়া প্রদান করত। হযরত আছিয়া তখন জান্নাতে তাঁর আবাসস্থল অবলোকন করতেন।


    হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ফেরাউন তার স্ত্রী আছিয়ার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে চারটি পেরেক পুঁতে বুকের উপর ভারী পেষণ-যন্ত্র স্থাপন করে রেখেছিল। এহেন অবস্থায় তার চেহারা প্রখর রৌদ্রে উত্তপ্ত সূর্যের দিকে ফিরিয়ে রাখত । এ সময় হযরত আছিয়া আকাশপানে মাথা তুলে দোয়া করতেন, ‘ওগো আল্লাহ্! তোমার অতি নিকটে জান্নাতের মাঝে আমাকে আবাস দান কর।'


    হযরত হাসান (রঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, 'আল্লাহ্ তা'আলা হযরত আছিয়াকে অতি উত্তমরূপে মুক্তি দিয়ে এবং জান্নাতে তাঁকে অতি উচ্চ মর্যাদা প্রদান করেছেন। তিনি জান্নাতের সকল স্থানে বিচরণ করেন এবং পানাহার করে থাকেন।' সুতরাং ইবাদতকারীর কর্তব্য হচ্ছে, সদাসর্বদা আল্লাহ্র নিকট গুনাহ মাফ চাওয়া; কেবল তাঁরই নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করা। কেননা, বিপদ আপদে উৎপীড়ন থেকে মুক্তির জন্য প্রার্থনা করা পূতঃ-পবিত্র নেক বান্দাদের তরীকা এবং এটাই প্রকৃত ঈমানের লক্ষণ।'


    লেখাটির মঝ্য ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।


    LikeYourComment