বাংলা অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের প্রচার।

বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে আউলিয়াদের অবদান, বাংলাদেশে কে প্রথম ইসলাম প্রচার করেন, বাংলাদেশে প্রথম ইসলাম প্রচার হয় যে মসজিদ থেকে


    এই পাঠটি পড়ে আপনি জানতে পারবেন - বাংলা অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের প্রচার।







    • মুসলমান সমাজে শ্রেণী বিভাজন।

     • অতীন্দ্রিয়বাদ ও বাউল ধর্মের প্রভাব।

    • ধর্মীয় পুনরুজ্জীবন আন্দোলন।

    • উপনিবেশ ও শ্রেণী শোষণ বিরোধী সংগ্রাম।



    বাংলা অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের প্রচার।


    ইসলাম ধর্মের সাে বাণী বাংলা অঞ্চলের কৃষক সমাজের দরিদ্র মাধ্যমে তাদের অনেকে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেও শুরু করেন। একাদশ থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত পীর, মানুষজনকে আকৃষ্ট করে।

    বাংলা অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে ইসলাম ধর্মের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয় সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীতে। আরব বণিকগণ তখন বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের উপকূলবর্তী অঞ্চলসমূহে আসেন। বৈবাহিক সম্পর্কের দরবেশ ও সূফী সাধকগণ আসেন। তারা বাংলা অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে বসবাস শুরু করেন। এসব সাধকগণ প্রধানত পারস্য, বাগদাদ ও আফগানিস্তান থেকে উত্তর ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। ১২০১ সালে মুসলমানদের কাছে সেন বংশের শেষ শাসক লক্ষণ সেনের পরজায় ঘটে। এর ফলে বাংলা অঞ্চলের শাসন ক্ষমতা মুসলমান শাসক গোষ্ঠীর হাতে চলে যায়। তখন থেকে বাংলায় মুসলমান সাধকগণের আগমন আরো বৃদ্ধি পায়।

    বাংলা অঞ্চলের কৃষক সমাজের মানুষজনকে ইসলাম ধর্ম আকৃষ্ট করে। অনেক দরিদ্র কৃষক যারা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ধনী কৃষকদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে উঠেছিলেন তারা নতুন ধর্ম পরিচয়ের মধ্যে মুক্তির সন্ধান করেন। ইসলাম ধর্মের সাম্যের বাণী তাদেরকে ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট করে। সর্বোপরি কৃষকগণ অর্থনৈতিক দারিদ্রের পাশাপাশি অসুস্থতা, বঞ্চনা, শোক, দুঃখ-কষ্ট ইত্যাদি থেকে মুক্তির জন্য মুসলমান পীর দরবেশদের সান্নিধ্যে আসেন। মুসলমান সাধকগণ কৃষক সমাজেই বসবাস করেন বলে কৃষকের যন্ত্রণা ও দুর্দশার অনুভূতির অংশীদার হন। ঝাড়ফুক, পানিপড়া, তাবিজ ইত্যাদি দিয়ে তারা চিকিৎসা করেন। সাধকগণের উচ্চমার্গের আধ্যাত্মিক ক্ষমতা, প্রভাবিত করার ঐন্দ্রজালিক দক্ষতা, সহজ জীবনযাত্রা ও বদান্যতা কৃষক সমাজকে মুগ্ধ করে। দলে দলে মানুষ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন।



    ইসলাম ধর্মের সঙ্গে দেশীয় সংস্কৃতির সমন্বয়।


    ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর বাঙ্গালী মুসলমানদের আদি বিশ্বাস, আচার আচরণ, প্রথা ইত্যাদিতে খুব একটা বদল ঘটে নি। কারণ ধর্মের আনুষ্ঠানিতকার চেয়ে আধ্যাত্মিকতা অধিক গুরুত্ব পায়। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন আঞ্চলিক বিশ্বাস ও সংস্কৃতির সঙ্গে ইসলাম ধর্মীয় বিশ্বাসের সমন্বয় ঘটে (syncretization) (রায় ১৯৮৪)। এটি ঘটে কারণ বাংলা অঞ্চলে সূফী সাধকগণ ধর্ম প্রচার করেন। সূফী অতীন্দ্রিয়বাদ (mysticism) এর মূল দর্শন হচ্ছে স্রষ্টাকে ভালোবেসে আত্মসমর্পণ করতে হবে।

    স্রষ্টার প্রতি প্রেমই মূল ধর্ম। সূফী দর্শনের সঙ্গে ধর্মান্তরিত মুসলমানদের আদি বিশ্বাসের কোন অমিল নেই। a Asim Roy. The Islamic Syncretistic Tradition in Bengal, Princeton University Press,

    Princeton, 1984,





    সূফী সাধকগণ আরো প্রচার করেন যে দরবেশ বা আউলিয়াগণ স্রষ্টার অনুগ্রহ প্রাপ্ত এবং সে কারণে তারা ধর্মান্তরিত হওয়ার পরও বাঙ্গালীদের উত্তরাধিকার প্রতি ভক্তি প্রদর্শন ধর্মীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। বাংলা অঞ্চলে প্রাচীনকাল থেকে বসবাসের ফলে সূত্রে প্রাপ্ত জীবনাচার পালন করা সম্ভব হয়।

    মানুষ এবং স্রষ্টার মধ্যে যোগাযোগকারী মাধ্যম হিসেবে কাজ করেন। এর ফলে বাংলা অঞ্চলে পীরদের বংশানুক্রমে যে জীবনাচার বাঙ্গালীরা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন তা পালন করেও নতুন ধর্ম পালন করা সম্ভব হয়ে উঠে। ধর্মান্তরিত হলেও বাঙ্গালী সমাজের ধারাবাহিকতা ও জীবনযাত্রা প্রণালীর ব্যাপক রদবদল ঘটেনি।




    মুসলমান সমাজে শ্রেণী বিভাজন।


    ধর্মান্তর দরিদ্র কৃষকগনকে মুসলমান কৃষকদের মধ্যে উঁচু-নীচু বিভাজন ছিল খুব স্বাভাবিক। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার নতুন পরিচয় দিলেও ভিত্তিতে উচ্চ শ্রেণী ও নিম্ন শ্রেণী বিভাজন কার্যকর ছিল। এতদ্ব্যতীত মর্যাদার ভিত্তিতে আশরাফ, আতরাফ সমাজে বিদ্যমান শ্রেণী ও আজলাফ স্তর বিন্যাস গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। সাধারণত শহরে বসবাসকারীগণ ও ধনী কৃষকগণ বৈষম্য নিসরন হয় না।






    ধর্মান্তর দরিদ্র কৃষকগণকে নতুন পরিচয় দিলেও সমাজে বিদ্যমান শ্রেণী বৈষম্য নিসরন হয় না। গ্রামাঞ্চলে নিজেদেরকে সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে আশরাফ মর্যাদার অধিকারী বলে দাবী করেন। বাংলার গ্রামাঞ্চলের কৃষকগণকে নিম্ন মর্যাদার আতরাফ বলে অভিহিত করা হয়। আশরাফ মর্যাদার অধিকারীগণ আতরাফদেরকে ধর্মীয় বিশ্বাস ও চর্চার দিক থেকে অশিক্ষিত ও অন্ধকারাচ্ছন্ন বলে বিবেচনা করেন। আশরাফগণ দাবী করেন যে তাদের আদি নিবাস বাংলা নয় কারণ তারা আরবদের বংশধর। ধর্মীয়ভাবে তারা ইসলামের সঠিক অনুসারী বলে দাবী করেন। ফারসী ও উর্দু ভাষাকে তারা নিজেদের ভাষা বলে মনে করেন। রাজনৈতিকভাবে তারা শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কিত। অর্থনৈতিকভাবে এই শ্রেণীটি ধন সম্পদ ও প্রভাব প্রতিপত্তির একচছত্র ক্ষমতার অধিকারী। এভাবে সাধারণ দরিদ্র কৃষক সমাজের মুসলমানদের সঙ্গে উচ্চ মর্যাদার বিত্তবান শ্রেণীভুক্ত মুসলমানদের দূরত্ব স্পষ্ট হয়ে উঠে।






    ইসলাম ধর্ম ও নানাবিধ আধ্যাত্মবাদ।


    বাংলা অঞ্চলের কৃষকগণের জীবনবোধে এক চিরন্তন 'দুঃখ' ও 'শূন্যতা' কাজ করতে দেখা যায়। এর সমাজের উচ্চ-নীচ বহিঃপ্রকাশ ঘটে পল্লীগীতি, লোকগাঁথা ও প্রবাদ প্রবচনে। যেমন, 'নদীর একুল ভাঙ্গে ওকূল গড়ে এই তো বিভাজন ও জাতি নদীর খেলা'। এ দুঃখ বোধ সমাজ ব্যবস্থার শোষণ, বঞ্চনা ও অত্যাচার নিপীড়ন থেকে সৃষ্ট। উপমহাদেশে বিভাজনের বিরুদ্ধে মুসলমান শাসনামলে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাংস্কৃতিক জীবনে সম্পদশালী ও উচ্চ অতীন্দ্রয়বাদে বিশ্বাস এক মর্যাদাশীলদের আধিপত্য অক্ষুন্ন থাকে। সাধারণ মানুষের দুঃখ কষ্ট ও যন্ত্রণা কমে না। কৃষক সমাজে ধরনের প্রতিবাদ ।





    অতীন্দ্রিয়বাদের দর্শন ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। এই ধর্মীয় বিশ্বাসের মূল বাণী হচ্ছে- জীবন আনন্দময় ও দুঃখহীন হতে পারে। ভোগবাদী লিপ্সার কারণে দুঃখ যন্ত্রণা তৈরী হয়। ভোগের ইচ্ছাকে দমন করলে জীবন আনন্দময় হয়ে উঠে। অতীন্দ্রিয়বাদে বিশ্বাসী হয়ে উঠেন শোষিত শ্রেণী। সমাজের উচ্চ-নীচ বিভাজন ও জাতি বিভাজনের বিরুদ্ধে তাদের বিশ্বাস এক ধরনের প্রতিবাদ। বাঙ্গালী দরিদ্র কৃষকগণ তাদের অন্তর্নিহিত বঞ্চনা ও যন্ত্রণার নিগূঢ় অর্থ খুঁজে পান বাউল ধর্মে। বাংলা অঞ্চলে সাধারণ মানুষের মানে বাউল ধর্ম ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। সামাজিক বিভাজনের বিরুদ্ধে লালন ফকীর আওয়াজ তুলেন।





    জাত গেল জাত গেল বলে একি আচল কারমান সত্য পথে কেউ নয় সব দেখি তা না না

    যখন তুমি ভবে এলে তখন তুমি কি জাত ছিলে কি জাত হবা যাবার কালে সেই কথা কেন বল না

    ব্রাহ্মণ চন্ডাল চামার মুচি এক জনেতে সবাই ি দেখে শুনে হয় না রমতো কাকেও ঘোবে না

    গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায় তাতে জাতির কি ক্ষতি হয় লালন বলে জাত কারে কয় এ ভ্রম তো আর গেল না।





    ধর্মীয় পুনরুজ্জীবন।


    ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের পর মুসলমানদের রাজনৈতিক ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। মুসলমান এলিটগণ, নেতৃবর্গ, সরকারী চাকুরীজীবী ও সেনাবাহিনীর অধিকাংশ চাকুরীচ্যুত হয়ে পড়েন। ফারসীর বদলে সরকারী কার্যক্রমে ইংরেজি ভাষা চালু হয়। মুসলমানদের সামাজিক মর্যাদাও ক্ষুণ্ণ হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ভূমি ব্যবস্থা পরিবর্তন করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কায়েম করেন। জমিরদারগণ সাধারণ কৃষকদের কাছ থেকে ইচ্ছামত খাজনা আদায় ও জমি থেকে উচ্ছেদ করার অধিকার প্রাপ্ত হন। জমিদারদের সমর্থক উপস্বত্বভোগী দল সৃষ্টি হয় যেমন, পশুনিদার, তালুকদার ইত্যাদি। মহাজন নামে আরেকটি দল সৃষ্টি হয়। যারা কৃষকদের জমি বন্ধক রেখে নগদ অর্থ ঋণ হিসেবে প্রদান করেন। কৃষকগণ খাজনার টাকা যোগাড় করার জন্য মহাজনদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এতসব স্বার্থভোগী দলের শোষণ ও উৎপীড়নে অতিষ্ট হয়ে উঠে সাধারণ কৃষকের জীবন এবং তারা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন।

    বাংলা অঞ্চলে অধিকাংশ জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগী এবং মহাজনগণ ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত। হিন্দু জমিদারগণ কর্তৃক মুসলমান রায়তগণ অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে অত্যাচারিত হন। তাছাড়া হিন্দু জমিদারগণ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য বাড়তি খাজনা ধার্য করেন যেগুলিকে 'আবওয়ার' বলা হয়। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- শ্রাদ্ধকরচা, পৈতা করচা, রথ করচা দূর্গাপূজা করচা। হিন্দু জমিদারগণ তাদের জমিদারীতে গরু জবাই নিষিদ্ধ করেন। এতে মুসলমান রায়তগণ গরু পালন করে যে সুবিধা পেতেন তা থেকে বঞ্চিত হন।

    বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসকগণের কৃষি বাণিজ্যিকীকরণের ফলে মুসলমান কৃষকগণ অত্যাচারিত হন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারীগণ জমিদারদের কাছ থেকে জমি বন্দোবস্ত নিয়ে নীল চাষ শুরু করে। মুসলমান কৃষাণকে নীল চাষ করতে বাধ্য করা হয়। নীল চাষের শর্ত কৃষকের পক্ষে না থাকায় তারা ইংরেজ মালিকের কাছ থেকে অগ্রিম অর্থ নিতে বাধ্য হন। অর্থ পরিশোধ করতে না পারায় ঋণের দায়ে আবদ্ধ হয়ে নীল চাষের ক্ষেত্রে তারা ভূমিদাসে পরিণত হন।



    ঔপনিবেশিক শাসন ও জমিদারদের অত্যাচারে জর্জরিত ও অধঃপতিত মুসলমানগণকে পুনরুজ্জীবিত করার ঔপনিবেশিক শাসন ও জন্য ধর্মীয় সংস্কারবাদী আন্দোলন শুরু হয়। এসময় আরবে সংস্কারবাদী আন্দোলন শুরু করেন মোহাম্মদ জমিদারদের অত্যাচার বিন আব্দুল ওয়াহাব (১৭০৩-৯২)। তার নামানুসারে আরবে সংস্কার আন্দোলন ওয়াহাবী আন্দোলন নামে থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে পরিচিতি লাভ করে। এই আন্দোলনের মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হন ভারতের শাহ ওয়ালি উল্লাহ (১৭০৩. দরিদ্র মুসলমানগণকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ইসলাম অনুসরণের আহ্বান জানান। ১৮১৮ সালের দিকে সৈয়দ আহমদ শহিদ (১৭৮৬-১৮৩১) ও সৈয়দ ধর্মীয় সংস্কারবাদী আন্দোলন শুরু হয়।

    ৬২)। তিনি ইসলাম ধর্ম যেভাবে চর্চা করা হচ্ছে তার সমালোচনা করেন এবং শরিয়ত অনুযায়ী প্রকৃত ইসমাইল শহিদ (১৭৮২-১৮৩১) তরিকায়ে মোহাম্মদিয়া আন্দোলন শুরু করেন উত্তর ভারতে। এই সংস্কারবাদী আন্দোলন সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগায়। ইসলামী সংস্কারবাদী আন্দোলনে সবচেয়ে সফল আন্দোলন গড়ে উঠে পূর্ব বাংলায় হাজী শরিয়ত উল্লাহর (১৭৮১-১৮৪০) নেতৃত্বে। হাজী শরিয়ত উল্লাহর মৃত্যুর পর তার ছেলে মোহসিন আল দীন আহমদ (দুদু মিয়া) (১৮১৯-৬২) ফারায়েজী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তরিকায়ে মোহাম্মদিয়ার সংস্কার নীতি অনুসরণ করে পশ্চিম বাংলায় ভীতু মীর (১৭৮২-১৮৩১) গণ আন্দোলন গড়ে তোলেন।






    উপনিবেশ বিরোধী সংগ্রাম।


    উপমহাদেশে ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর উচ্চ শ্রেণীভুক্ত হিন্দুগণ বৃটিশ শাসকগোষ্ঠীর আনুকূল্য লাভ করে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হয়ে পড়েন। আর উচ্চ শ্রেণীভূক্ত মুসলমানগণ ইংরেজদের কাছে নতি স্বীকার করে কোন রকমে নিজেদের শ্রেণীগত অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করেন। এমন কি ইসলামী সংস্কারবাদী আন্দোলন দ্বারাও উচ্চ শ্রেণীর মুসলমানগণ অতটা প্রভাবিত হন নি। বরং বলা যায় দূরে সরে থাকেন। কারণ সংস্কারবাদী আন্দোলন জমিদার, জোতদার, মহাজন, ব্যবসায়ী শ্রেণীর অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। উচ্চ শ্রেণীর মুসলমানগণের অনেকের শ্রেণী স্বার্থ এতে বিঘ্নিত হয় এবং তারাও শ্রেণীগতভাবে আক্রান্ত হন। বলা যায় উচ্চ শ্রেণীর মুসলমানগণ বৃটিশ আধিপত্য মেনে নেয়াকেই শ্রেয় মনে করেন।

    বাংলার কৃষক শ্রমিক সাধারণ নিপীড়িত মানুষ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। সারা বাংলায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও সংগ্রাম গড়ে উঠে। ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে প্রথম গণকৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয় ফকীর সন্নাসীদের নেতৃত্বে। এই বিদ্রোহ ১৭৬৩ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়। বিখ্যাত মসলিন বস্তু উৎপাদনকারী তন্তুবায়দের বস্তুশিল্প ধ্বংসের প্রতিবাদ হয়। লবন শিল্প থেকে লুণ্ঠনের ফলে বিদ্রোহ হয়। সন্দ্বীপ (১৭৬৬), ময়মনসিংহ (১৭৮৭), যশোহর- খুলনা (১৭৮১-১৭৯৬), রংপুর (১৭৮৩), বাখেরগঞ্জ ( ১৭৮৭-১৭৯২) অঞ্চলে কৃষকগণ বিদ্রোহ করেন জমিদারের শোষণ ও ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে। ময়মনসিংহে পাগলপন্থী নামে খ্যাত গারো ও হাজংদের বিদ্রোহ ১৮২৫ থেকে ১৮৮২ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে তীতু মীর সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করেন ১৮৩০ সালে। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে নীল বিদ্রোহে ঘাট লক্ষের অধিক কৃষক অংশগ্রহণ করেন।






    মাতৃভূমি বিধর্মীদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ায় বৃটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষিত হয়। সংস্কারবাদী কর্তৃক ব্রিটিশ শাসকদের আন্দোলন উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনের রূপ লাভ করে। জামিদার, নীলকর, মহাজনদের শোষণ ও বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষিত হয়।

    ইসলামী সংস্কারকগণ বৃটিশদের অধীনস্ত ভারতবর্ষকে 'দার-উল-হারব' বলে আখ্যায়িত করেন। তার মানে ইসলামী সংস্কারকগণ উৎপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ায় নিম্ন শ্রেণীর মুসলমানগণ ব্যাপক হারে বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেন। ফরায়জী আন্দোলনের কেস স্টাডি উপস্থাপিত হলো।








    কেস স্টাডি ১


    ফরায়জী আন্দোলন "ফরায়জী" শব্দের অর্থ "ফরজ' বা আল্লাহর আদেশ পালন। হাজী শরিয়ত উল্লাহর মৌলিক সংস্কারের অন্তর্ভুক্ত ছিল ফরজ সম্পর্কে জ্ঞান দান। যারা ফরজ পালন করতেন তারাহ ফরায়জী। তিনি আল্লাহর শরিক হওয়ার মত কাজ নিষেধ করেন যেমন পীর পূজা, কবর পূজা ইত্যাদি। ইসলাম অননুমোদিত কাজ না করার জ তিনি উপদেশ দেন যেমন মহররমে শোক করা, গাজি-কালুর প্রশস্তি গাওয়া ইত্যাদি। শরিয়তউল্লাহ পীর- মুরীদ প্রথা বাতিল করেন। কারণ এতে বহু নৃত্যের ন্যায় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি উম্মাদ সাগরেদ বা শিক্ষক-শিক্ষার্থী শব্দ ব্যবহার করার কথা বলেন। তিনি পাপ মোচনের জন্য তওবা করা, অনুতাপ করা ও সত্য ন্যায়ের পথে চলার শপথ গ্রহণকেই যথেষ্ট মনে করতেন। তওবার ভাষা ছিল বাংলা। শরিয়ত উল্লাহর ধর্ম সংস্কার কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের ধর্মে পরিণত হয়। তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে জেহাদ বা ধর্ম যুদ্ধ করাকে মুসলমানদের কর্তব্য বলে ঘোষণা করেন। হাজী শরিয়তউল্লাহ ১৭৮১ সালে মাদারীপুর জেলায় অনুগ্রাহণ করেন। সম্ভবত তিনি একজন ছোলা বা তাঁতীর গৃহে অনাগ্রহণ করেন। আঠার বছর বয়সে মক্কায় হজ্জ করতে যান। সেখানে তিনি সাহাবী আন্দোলনের সঙ্গে পরিচিত হন এবং আরবী ভাষায় পান্ডিত্য অর্জন করেন। ১৮২০ সালে দেশে ফেরার পর তিনি একদল ডাকাতের হাতে পড়েন। সব কিছু হারিয়ে তিনি ডাকাতদলের সঙ্গেই থেকে যান এবং তাদের সঙ্গে ধর্ম নিয়ে আলোচনা করেন। ডাকাতরা তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তারাই ধর্ম প্রচারের বাহিনী গঠন করেন।

    শরিয়তউল্লাহ ঢাকা ও ফরিদপুর জেলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে ধর্মমত প্রচার করেন। ধর্ম সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে তিনি শিষ্যদের অর্থনৈতিক ও অন্যান্য শোষণ নিপীড়নের কবল থেকে মুক্ত করায় সচেষ্ট হন। র মধ্যে শরিয়তউল্লাহর ব্যাপক প্রভাব পড়ে এবং কৃষকদের সংঘবদ্ধতা ও কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। এতে অমিদার গোষ্ঠী ও ধনী মুসলমানগণ একত্রিত হয়ে শরিয়তউল্লাহকে বিতাড়িত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। জমিদার, নীলকরা মহাজনদের সঙ্গে তার বিরোধ বাধে। বিভিন্নভাবে তিনি নিগৃহীত হন। তথাপি প্রচার কাজ চালিয়ে

    ১৮৮৪০ সালে শরিয়ত উল্লাহর মৃত্যুর পর তার ছেলে দুদু মিয়া ফরায়জী মতবাদ প্রচারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনিও অল্প বয়সে হচ্ছ করেন। ফিরে এসে জমিদারী শোষণ ও বিদেশী শাসন উচ্ছেদ করে। স্বাধীন রাজা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন। শরিয়তউল্লাহর ধর্মীর সংগ্রামকে সুদু মিয়া স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে পরিচালনা কে

    আন্দোলনকারীগণ হিন্দু ও কারো নেই। কারণ জমির মালিক আল্লাহ কোন মানুষ নয়। দুদু মিয়া ঘোষণা করেন যে ব্যক্তিগত মুসলামান জমিদার ও ব্যবহারের উদ্দেশ্যে বংশ পরম্পরার জমি দখল করে রাখার অধিকার কারো নেই। তিনি তেইশ ধরনের নীলকাদের বিরুদ্ধে সশস্ত কর দিতে সাগরেদদের নিষেধ করেন। জমিদার ও নীলকরদের যাতে কর দিতে না হয় সেজন্য তিনি ইসলামী সংস্কারবাদী গ্রামে গ্রামে বিচারালয় প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রামের বৃদ্ধ কৃষকের অধীনে বিচার কাজ পরিচালিত হতো। পূর্ন আন্দোলন শ্রেণী সংগ্রামে | বাংলাকে বিভিন্ন হালক বা অঞ্চলে ভাগ করা হয়। প্রতিটি অঞ্চলে লীফা বা প্রতিনিধি ছিলেন। পলীফাগণ

    ফারাজী দুলু মিয়া গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রচার করেন যে সব মানুষ সমান। আল্লাহর দুনিয়ায় কর ধার্য করার অধিকার সংগ্রাম শুরু করেন। কৃষকদের সরকারী খাস জমিতে গিয়ে বসবাসের নির্দেশ দেন। স্বাধীন রাজা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে দুদু মিয়া রূপ লাভ করে। ফরায়জীদের একত্রিত রাখতেন। শিয়াদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে কেন্দ্রীয় তহবিল গঠিত হয়। কোথাও কোন কৃষক নিগৃহীত হলে এই তহবিল থেকে সাহায্য করা হতো। একটি শক্তিশালী পাঠিয়াল বাহিনী

    গঠিত হয়। জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য পাঠিয়াল বাহিনী ব্যবহার করা হতো। দুদু মিয়ার সংগ্রাম ছিল জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে। তার পরিকল্পনা কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। হিন্দু কৃষক ও দুলু মিয়ার নেতৃত্বে সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। এই সংগ্রাম ক্রমশ ফরিদপুর, বিক্রমপুর, খুলনা, চব্বিশ পরগায় বিস্তৃতি লাভ করে। দুদু মিয়া শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলেন।



     যে কোন সময় তার নেতৃত্বে পঞ্চাশ হাজার হিন্দু মুসলমান কৃষক জমিদার নীলকরদের বিরুদ্ধে লাঠি হাতে লড়াই করতে প্রস্তুত ছিলেন। জমিদার নীলকরগণ দুদু মিয়ার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হন। কৃষকগণকে শাস্তি দেবার জন্য জমিদাররা নৃশংস পথ অবলম্বন করেন। যেমন কয়েকজন কৃষকের দাড়ি একত্রে বেঁধে নাকে মরিচের গুড়া ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এর প্রতিবাদে দুদু মিয়ার লাঠিয়াল বাহিনী ও কৃষকগণ জমিদারদের সম্পত্তি ও কুঠি ধ্বংস করেন। এভাবে বিভিন্ন স্থানে শ্রেণী সংঘর্ষ চরম আকার ধারণ করে। অবশেষে দুদু মিয়াকে গ্রেফতার করা হয় এবং ১৮৬২ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

    উৎস : সৈয়দ আমীরুল ইসলাম, বাংলাদেশ ও ইসলাম, জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ঢাকা, ১৯৯৯।








    সারাংশ।


    ইসলামের পুনরুজ্জীবনের জন্য বাংলা অঞ্চলের সংস্কারকগণ যে বাণী প্রচার করেন তা নিঃসন্দেহে ধর্মীয়। তারা প্রচার করেন যে নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করতে হলে সর্বাগ্রে নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে দৃঢ় করতে হবে। ধর্মের মূলধারা অনুসরণের জন্য তারা আহ্বান জানান। কোরআন ও হাদীস অনুসারে জীবন যাপনের কথা বলেন। সুন্নী মুসলমান হিসেবে ইসলামের নিয়ম কানুন সঠিকভাবে মেনে চলার উপর তারা জোর দেন। ধর্মীয় চর্চায় যেসকল অনৈসলামিক বিষয় ঢুকে পড়েছে তা পরিত্যাগ করার জন্য আহ্বান জানানো হয়। এভাবে মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার শক্তি অর্জনের জন্য ধর্মকে কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসা হয়।

    বাংলা অঞ্চলে ইসলামী সংস্কারবাদী আন্দোলন শ্রেণী সংগ্রামে রূপ লাভ করে। প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে যে বাংলার মুসলমানদের মধ্যে যখন উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ বিরাজমান তখন দরিদ্র মুসলমান কৃষকগণ কেন সংস্কারবাদী আন্দোলনে শরীক হন? উল্লেখ্য যে ইসলামী সংস্কারক ও ফরায়জী আন্দোলনের নেতা হাজী শরিয়তউল্লাহ আরব বংশদ্ভূত আশরাফ তরভুক্ত ছিলেন না। তিনি ছিলেন গ্রামে জন্মগ্রহণ করা অশিক্ষিত ও ক্ষুদ্র কৃষক। তার ছেলে দুদু মিয়াও একই স্তরভূক্ত ছিলেন। তীতু মীর জীবনের প্রথম ভাগে ভবঘুরে ও প্রতিবাদী মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সংস্কারবাদী আন্দোলনের নেতৃবর্গ সাধারণ কৃষকের স্তরভুক্ত হওয়ায় এবং গ্রামে বসবাস করায় তাদের বক্তব্য সহজেই দরিদ্র শ্রেণীর মুসলমানদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠে।





    LikeYourComment